দিনাজপুর ট্র্যাজেডি দিবস আজ

img

বিশেষ প্রতিবেদক:

আজ ৬ জানুয়ারি। দিনাজপুরের মহারাজা স্কুল মাইন বিস্ফোরণ ট্র্যাজেডি দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে দিনাজপুরের মহারাজা স্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে এক আকষ্মিক মাইন বিস্ফোরণে একসঙ্গে শহীদ হন মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনা ৫ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন অনেকেই।

ইতিহাসের পাতায় এই দিনটি একটি শোকাবহ দিন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে এতবড় ট্র্যাজেডির ঘটনা আর দ্বিতীয়টি নেই। দিবসটি উপলক্ষে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস। দীর্ঘ ৯ মাস জীবনের বাজি রেখে পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধারা লাল সবুজের একটি পতাকা ও একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র জাতিকে উপহার দিয়ে বাড়িতে ফিরে গিয়ে পরিবার পরিজনের সাথে আনন্দ উৎসব করার কথা। কিন্তু তারা মনে করেছিলো দেশ স্বাধীন হলেও দেশবাসী এখনো শংকামুক্ত নন।

দেশ স্বাধীন হলেও পাকি সেনাদের পুতে রাখা মাইনের কারণে এদেশে ভূমি এখনো দেশবাসীর জন্য স্বাধীন নয়। তাইতো তারা এদেশের ভূমিকে দেশবাসীর জন্য স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার উপযোগী করতে নিয়োজিত হয়েছিলেন পুতে রাখা মাইন অপসারণের কাজে।

দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়িস্থ মহারাজা স্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্প। বিজয় অর্জনের পর ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ক্যাম্পে এসে সমবেতন হন দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ আশপাশের জেলাগুলোর মুক্তিযোদ্ধারা। তারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হামজাপুর, তরঙ্গপুর, পতিরাম ও বাঙ্গালবাড়ি ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখানে সমবেত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮ শতাধিক।

সমবেত মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাদের ফেলে যাওয়া, লুকিয়ে রাখা ও পুঁতে রাখা মাইন ও অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ উদ্ধারের কাজ করতেন। উদ্ধার মাইন ও অস্ত্র জমা করা হতো মহারাজা স্কুলের দক্ষিণাংশে খনন করা বাংকারে। ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি মাগরিবের নামাজের পর দুটি ট্রাক থেকে মাইন নামানোর সময় হঠাৎ এক মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে একটি মাইন ফসকে পড়ে যায় জড়ো করা মাইনের ওপর।

সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফোরণ ঘটে জড়ো করা হাজারও মাইনের। কেঁপে উঠে গোটা দিনাজপুর। প্রাণ হারান সেখানে অবস্থান নেয়া পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। আহত হয় শত শত মুক্তিযোদ্ধা।

ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় আহত বীরমুক্তিযোদ্ধা দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার চরাড়হাট গ্রামে আব্দুর রহমানের পুত্র আব্দুর রশিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সে দিন মাইন বিস্ফোরণে কতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায়নি। তবে সকালের রোলকলে উপস্থিত ছিলেন ৭৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা। দুর্ঘটনার পূর্বে ৫০ থেকে ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছুটি নিয়ে ক্যাম্প ত্যাগ করেছিলেন। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সাড়ে ৪শ মুক্তিযোদ্ধা তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলেই নিহত হন।

তিনি আরো বলেন, দুর্ঘটনার পর পরই শতাধিক আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ভর্তি করা হয়েছিল দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল ও সেন্ট ভিসেন্ট মিশন হাসপাতালে। এদের মধ্যে থেকে পরে ২৯ জন মারা যায়। তাকে ভর্তি করা হয়েছিল দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে ১৭ দিন চিকিৎসার পর তার জ্ঞান ফিরেছিল। পরে তাকে ভারতের কলকাতার একটি হাসপাতালে সাড়ে ৪ মাস চিকিৎসার পর শরীরের বাম পা কেটে ফেলে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। এখন এই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা সরকারি ভাতা পান। ওই দুর্ঘটনায় তার মতো আরো ৩৭ জন মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন স্থানে জীবিত থেকে সরকারি ভাতা পাচ্ছেন।

অন্যদিকে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক ছুটু জানিয়েছেন, স্বাধীনতার পরপরই একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে একসাথে এত সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিহতের ঘটনা দেশে আর কোথাও হয়নি। তাই এই স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়ার দাবি সকলের।

সেদিনের সাক্ষী যে মহারাজা স্কুল সেখানে সেদিনের যেসব স্মৃতি তা নতুন প্রজন্ম ও দেশবাসীকে জানানোর জন্য একটি জাদুঘর নির্মাণের দাবি জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনচেতা মানুষেরা।